দিন এনে দিন খাওয়া মুড়ি-তেলেভাজা বাঙালির জীবনে শীৎকার বলে কিছু কি ছিল কোনও কালে? আটপৌরে একান্নবর্তিতায় সে চিৎকারকে যতটা জানে, চেনে, মানে, শীৎকার তার কাছে ততটাই অচেনা।
সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় ঢাক ও ঢোল পিটিয়ে জানানো হয়েছে, উচ্চস্বরে শীৎকারসহ সঙ্গম স্বাস্থ্যের পক্ষে নাকি দুর্দান্ত। এলি-তেলি-পঞ্চানন নয়, এই ‘হেল্থ-বাণী’-টির উদ্গাতা সুইডেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েল উইকস্ট্রম। আর নিজের ভাল মানে যেহেতু সমাজেরও ভাল, সেই কারণে যত বেশি শীৎকার, সামাজিক মঙ্গলও নাকি ততখানিই বেশি। সাইকোথেরাপিস্টরা রীতিমতো গবেষণা করে এই রায় দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সংবাদ-কর্তারা। দেখে ভারি ভাল লাগল ব্যাপারটা। লুকোছাপার দিন তাহলে শেষ! এবার সবকিছুই খুল্লমখুল্লা! আর যাই হোক, স্বাস্থ্যটাকে তো রাখতে হবে!
সুইডেনের কথা বাদ দিন। সে দেশ আম-বাঙালির রেঞ্জের বাইরে। দিন এনে দিন খাওয়া মুড়ি-তেলেভাজা বাঙালির জীবনে শীৎকার বলে কিছু কি ছিল কোনও কালে? আটপৌরে একান্নবর্তিতায় সে চিৎকারকে যতটা জানে, চেনে, মানে, শীৎকার তার কাছে ততটাই অচেনা। আজি হতে শতবর্ষ আগে বাঙালির জীবনে অবৈধ প্রেম ছিল, কুঞ্জবনের আবডালে চুকুরচুকু ছিল, তা পার করে ইন্টুমিন্টুও যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। কিন্তু শীৎকার, যাকে হিন্দিতে বলে ‘চীখ’ তা তেমনভাবে ছিল না। যৌথ সংসারে এজমালি ঘরে যৌনতা ছিল সন্তানার্থে। সেখানে শীৎকার মোটেই প্রশস্ত নয়। তার পরে যদিবা নিউক্লিয়াস পরিবার তৈরি হল, সেখানেও খুব সুবিধে করতে পারেনি বাঙালি। তার কারণ সম্ভবত ওই এজমালি জীবনের অবশেষ। বেগ চেপে আর আবেগ চেপেই যে বাঙালি তার সর্বস্ব হারিয়েছে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ এই সাইলেন্ট যৌনজীবন।
এক সময়ে বাঙালির চোখ ফুটেছে। ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি ভিএইচএস প্রযুক্তি এদেশে লভ্য হলে বাঙালি নীলছবি দেখে নয়ন সার্থক করে। সেই প্রথম বোধ হয় তার প্রতীতি জন্মায়, ‘লাউড সেক্স’ বলে একটা বস্তু এ মরসংসারে রয়েছে। বাঙালি তাতেও খুব বেশি সুবিধে করতে পারেনি অবশ্য। কারণ, চরম গোপনীয়তায় দেখা ভিডিওবাজিতে কোনও দিনই সাউন্ড বেশি দিতে পারেনি সে। টেকনোলজি যখন লম্বা পা ফেলে অরুণোদয়ের পথে হাঁটতে শুরু করেছে, বাঙালির পানুদর্শন তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে সাইলেন্ট মুভি-র যুগে। সে জগতে শীৎকার থাকাও যা, না থাকাও তাই।
শীৎকার নেই, কিন্তু চিৎকার তো পুরোমাত্রায় ছিল বাঙালির জীবনে। ‘অনামুখো মিনসে’, ‘অলপ্পেয়ে’, ‘অলম্বুষ’ থেকে ‘হারামজাদা’ পর্যন্ত স্বরব্যঞ্জন কবে না বর্ষিত হয়েছে বাঙালি পুরুষের কপালে! আর সেই সব চিৎকারের উৎস বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বামাকণ্ঠ। সেই তীক্ষ্ণভাষিণী সারাদিন চিল্লে বাড়ি মাথায় তুলে রাতে স্বামীর বাহুলগ্না হয়ে ‘উঁফ আঁফ ফোঁস ফোঁস’ করবেন, একথা তামা-তুলসি-গঙ্গাজলেও কেউ বিশ্বাস করবেন না। আর একথাও বাঙালি বিশ্বাস করে যে, চিৎকার করাও স্বাস্থ্যের পক্ষে দুর্দান্ত। এতে নাকি হার্ট ভাল থাকে।
আজ বাঙালির ঝুলিতে রেভ পার্টি রয়েছে, রিসর্টবাজি রয়েছে, এসকর্ট সার্ভিস, চ্যাটিং সাইটও রয়েছে। কিন্তু একটা প্রপার শীৎকার রয়েছে কি?
এই জন্যেই তো লোকে বলে, বাঙালির সব ভাল, কেবল হেল্থটাই যা…